২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া সৃজিত
মুখার্জির ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিল্ম বাইশে শ্রাবণ আপনাকে একটু ভাবতে হবে এর জনরা নিয়ে।
এটি দেখার আগে ভাবতাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু নিয়ে বানানো হয়েছে এ সিনেমা। তবে
দেখার পরে বুঝতে পারি এখানে রবীন্দ্রনাথ নেই, আবার না থেকেও আছেন। যদিও বলা হয়েছে এটি
ক্রাইম থ্রিলার কিন্তু সিনেমাটি সম্পূর্ণ দেখার পর মনে হতে পারে সৃজিত মুখোপাধ্যায়
একটি সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলার বানিয়েছেন অথবা একে ক্রাইম কাম রোম্যান্টিক ফিল্ম বললেও
ভুল বলা হবে না।
এখানে রহস্য রয়েছে যা অনেকটা
মাকড়শার জালের মতো, কিন্তু আপনাকে তা বিভ্রান্ত করবে। শুধু রহস্য কবা সিরিয়াল কিলিং
নয় এখানে সমাজে দৈনন্দিন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সুনিপুণভাবে। অভাব-অনটন, সংঘাত, স্বার্থ,
বেঁচে থাকার অভিপ্রায়, ধোঁকা ইত্যাদি ফুটে উঠেছে এই সিনেমায়।
শ্রী ভেংকাটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায়
নির্মিত এ সিনেমার প্রধান অংশের গুরুত্বপুর্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রবীর রায় চৌধুরী হিসেবে, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিজিৎ পাকড়াশি এবং গৌতম ঘোষ অভিনয়
করেছেন নিবারণ চক্রবর্তি চরিত্রে।
খুবই সাদামাটা একটি গল্পকে কিভাবে অভিনয়, গান,
কবিতা আর নাটকিয়তা দিয়ে পর্দায় অসাধারন ভাবে উপস্থাপন করা যায় তা এই বাইশে শ্রাবন বাংলা
সিনেমাটি না দেখলে হয়ত বোঝা যাবে না। একজন ব্যর্থ কবির মানসিক আচরণ ও কীর্তিকলাপ, সিরিয়াল
কিলিং, পুলিশি কর্মকাণ্ড নিয়ে মুল কাহিনী এগিয়েছে যার ফাঁকে আমরা সুন্দর একটি প্রেম
বা প্রেমের ত্রিভুজ দেখতে পাই।
শহরে আবির্ভাব হওয়া সিরিয়াল কিলারকে ধরার জন্য
মরিয়া প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা অভিজিৎ পাকড়াশী, কিন্তু কোনো কুল পেয়ে উঠতে পারছে
না। যার জন্য তাঁরই উর্ধতন কর্মকর্তা এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রবীর রায় চৌধুরীকে
ডেকে এনেছেন যিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন নিজের উগ্রতা, খামখেয়ালীপনা এবং বদমেজাজের জন্য
যার অধীনেই কাজ করতে হয় অভিজিৎকে। কিন্তু খুন হওয়া যেন থামছে না। আর এই খুনের যারা
ভিক্টিম তাঁরা কেউই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় অর্থাৎ সিরিয়াল কিলার সমাজের নিন্মতর শ্রেণির
কিছু মানুষকে খুন করে চলেছে। তবে এখানে একটি মজার বিষয় হলো খুন হওয়া প্রতিটি লাশের
পাসেই পাওয়া যায় কোনো না কোনো কবিতার লাইন।
সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য উদঘাটন ও কিলারকে ধরার
জন্য অভিজিৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দূরত্ব সৃষ্টি হয় তার প্রেমিকা বা বান্ধবী অমৃতার সাথে।
এখানে অমৃতার চরিত্রটি করছেন রাইমা সেন। অভিজিৎ ও অমৃতা লিভ ইন রিলেশানশিপে রয়েছে।
আর ফাঁকে দেখা যায় অমৃতার বাল্যকালের বন্ধু সুর্য সিনহার সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে
অমৃতা, এটা সেটা ভাগ করছে। সূর্য আবার অমৃতাকে ভালোবাসে। ওদিকে খুনের রহস্যের হিসাব
না মেলা ও এদিকে বান্ধবীর চলে যাওয়া অভিজিৎকে ফ্রাস্ট্রেশানের দিকে ঠেলে দেয়। সুর্য
নামের এই অপ্রধান অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি করেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।
নিবারণ চক্রবর্তির পাগলাটে ও খ্যাপাটে স্বভাব,
কলকাতা বইমেলায় তার আগুন লাগানোর ঘটনা, রাতবিরাতে ঘুরে বেড়িয়ে কবিতা বলে বেড়ানো, মানসিক
অস্থিরতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অভিজিৎ ধরে নিয়েছিল এই সেই
খুনি। সিরিয়াল কিলারের রেখে যাওয়া কবিতাংশের দ্বারা ধাঁধা বিশেষ বিশ্লেষণ করে বুঝতে
পারে মাইকেল মধুসূদনের মৃত্যু তারিখে আরেকটি ঘুন করতে চলেছে নিবারণ। কিন্তু সেদিন সেই
হতাশ কবি নিজেই খুন হয়ে থাকে যা সমস্ত হিসাব উল্টে দেয়।
তাহলে কে সেই খুনি? আর সেই খুনিকে আদৌ ধরা যাবে
কিনা? সে জিনিসটি জানার জন্য আপনাকে সিনেমা দেখার কথা না বলে বরং এখানেই স্পয়লার দিয়ে
দিতে চাই যেহেতু সিনেমাটি অনেক আগের। এই খুনি হলো সেই প্রবীর রায় চৌধুরী এবং বাইশে
শ্রাবণ অর্থাৎ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু দিনে আরেকটি খুন হওয়ার কথা। তবে বাইশে
শ্রাবণ সেই খুন না হয়ে, হয়ে যায় আত্মহত্যা। মধ্যিখান খান থেকে ক্রমিক খুনিকে ধরতে না
পেরেও সমস্ত ক্রেডিট চলে যায় অভিজিতের দখলে। আর নিজের মাথায় গুলি করার সময় প্রবীর রায়
আবৃতি করে গেছে শেষের কবিতার কিছু অংশ যা খুবই জনপ্রিয় এবং এ গল্পের সাথে প্রাসঙ্গিক-
ফিরিবার পথ নাহি
দূর হতে যদি দেখ চাহি,
চিনিতে পারিবেনা আমায়
হে বন্ধু, বিদায়।
একটি
মিস্ট্রি থ্রিলারে বুদ্ধির খেলা বড্ড বেশি জরুরি। এখানে কে খুনি তা চিনতে পারলেও চেনা
খুনিকে প্রমান সহকারে শনাক্ত করার যুক্তিগুলো কতটা বুদ্ধিনির্ভর বা যুক্তিনির্ভর তা
থেকে আমরা গল্পের আভিজাত্য বুঝতে পারা যায়। আর যারা এসব গল্পে অভ্যস্ত বা সিরিয়াল কিলিং
সম্পর্কে জানেন তাঁরা বের করার চেষ্টা করেন কিলারের সাইকোলজি কতটা যুক্তিগ্রাহ্য।
সিনেমাটি
মুক্তি পায় ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, আর আমি পর্যালোচনা করছি ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল।
সুতরাং ফলাফল বলে দেয়ায় খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে না। তবে স্পয়লার আর কতটুকু দেয়া যায়
ছোট্ট এক পর্যালোচনায়? আসল কাহিনী জানতে গেলে বা ঘটনা প্রবাহের স্বাদ নিতে গেলে কিংবা
স্বরুপ বুঝতে গেলে সিনেমাটি দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
প্রতিটি
চরিত্রে যারা অভিনয়ে ছিলেন তাঁদের চরিত্র অনুযায়ী অভিনয়, এক ব্যর্থ ও ক্ষুধার্ত কবির
যন্ত্রণা, উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের ঔদ্ধত্য ও অনুশোচনা, নাগরিক প্রেম, ক্রাইম ব্রাঞ্চের
অল্পবয়সী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে হতাশার চকচকে দৃশ্য, প্রাপ্ত বয়স্ক
ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব, গল্পে গল্পে বিভিন্ন কবিকে স্মরণ করা, অসাধারণ চিত্রগ্রহন ও
সম্পাদনা, অনুপম রায়ের ভিন্নধর্মি অথচ জীবনমুখী গান এবং সৃজিতের সৃজন এক অন্য উচ্চতায়
নিয়ে গেছে এই সিনেমা। কিন্তু মিস্টার মুখার্জির এই ফিল্মে গালাগালি কিংবা প্ররমব্রত
ও রাইমার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না দেখালেও পারতেন পরিচালক। মেনে নিতে অসুবিধা নেই যে,
তিনি অনেকটা অবাস্তব গল্পেও বাস্তব তুলে আনার চেষ্টা করেন।
ফিল্ম: বাইশে
শ্রাবণ
পরিচালক: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
প্রযোজক: শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস
রচয়িতা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
শ্রেষ্ঠাংশে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়,
রাইমা সেন, গৌতম ঘোষ, আবীর চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীত: অনুপম রায়
চিত্রগ্রাহক: সৌমিক হালদার
সম্পাদক: বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মুক্তি: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ
দেশ: ভারত
ভাষা: বাংলা
- মু. মিজানুর রহমান মিজান