![]() |
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ছবি: Tahsin, সিসি বাই-এসএ ৪.০, সংযোগ |
আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু স্লোগান ব্যবহার করছে যা সচতেন সমাজের নজর কেড়েছে। ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ চাইনা, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’, ‘পুলিশ আংকেল আপনার চায়ের খরচ আমার টিফিনের টাকা থেকে দেব, তাও ফিটনেস বিহীন গাড়ি চলতে দিয়েন না’, ‘জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে’, ‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি ইন্টারনেট চাইনা, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘যে দেশে শিক্ষকের হাতে বেত নিষিদ্ধ সে দেশে পুলিশের হাতে লাঠি কেন?’ ইত্যাদি স্লোগানযুক্ত প্লাকার্ড দেখা গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীরা আপত্তিকর শব্দও ব্যবহার করেছে যাকে মানুষ বলছে ওসব ওদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
কয়েকদিন আগে (২৯ জুলাই, ২০১৮) ঢাকার কুর্মিটোলায় শিক্ষার্থীদের চাপা দেয় একটি বাস যাতে নিহত হয় এক ছাত্র এবং এক ছাত্রী। এর ঠিক একদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় রাজধানীর উত্তরায় ১ জন এবং কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন আরো ২ জন। এমন করুন দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যখন দেখি বড় কর্তারা হেসে হেসে তাচ্ছিল্য করছেন তখন আমরা আম জনতার চাপা কান্না ব্যতিরেক আর কিবা করার থাকে?
চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এই ঢাকারই একটি ব্যস্ত সড়ক কারওয়ান বাজারে দুই বাসের ঘর্ষণে প্রথমে হাত ও পরবর্তিতে জীবন হারায় বাউফলের রাজীব, ছেলেটি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। আর এবার প্রাণ গেল শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ’এর দিয়া খানম মিম আর আবদুল করীম রাজীব। এর বাইরেও এমন অনেক ঘটনা ঘটছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের শহর ও হাইওয়ে গুলোতে। জানিনা এর শেষ কোথায় কিংবা এসবের সমাপ্তি আসলে আছে কিনা।
২০১৮ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যান সমিতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ থেকে জানা যায়‑ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলেয়ে ৪ হাজার ৯৭৯ টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে সর্বমোট ২৩ হাজার ৫৯০ জন যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন, আহত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন। এর মধ্যে হাত-পা বা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন ১ হাজার ৭২২ জন। রিপোর্টে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল‑ দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ।
কেন ঘটছে এমনসব দুর্ঘটনা? অপরিপক্ক চালক, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনো, বিপজ্জনক ও নিছক রসিকতার জেরে ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ইত্যাদিকে দায়ী করা যায়। পথচারীদের অসাবধানতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
মোহাম্মদপুরে এক টেম্পো ড্রাইভারের সাথে কিছু দিন আগে কথা হয়েছিল আমার যার বয়স আনুমানিক ১৫ বছর বা এর আশেপাশে হবে। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম এত কম বয়সে গাড়ির ড্রাইভার কেমনে হল। যেমনটি বলেছিল কিশোর টেম্পো চালক‑ ‘বয়স দিয়া আর কী বোঝবেন? আমগো লগেতো কতই বুইড়া বুইড়া মানুষ আছে, য্যারা অহনো ইস্টিয়ারিং ধরতে ডরায়। গাড়ি টানতে সাহস লাগে। পিচ্চি থেইকা এই লাইনে আছি’। কিন্তু লাইসেন্স আর পুলিশের ধরা না ধরার বিষয়টি সামনে আনলে সে বলে, ‘ওইডা কোন ব্যপার হইলো? আমগোরে হ্যারা চিনে’। আমি অনেকটা উদ্বিগ্ন, এই গাড়ি চালক যেখানে সে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে সে পিচ্চি কাল থেকে বাস টেম্পোর সাথে জড়িত আছে এবং এখন সে গাড়ি মালিকদের একজন ড্রাইভার যার ওপর তারা ভরসা করতে পারেন কিন্তু এই পিচ্চি কতটা বড় হয়েছে শরীর ও মনের শক্তির দিক থেকে? বাস টেম্পো মালিকরা বোধ হয় যোগ্যতর ব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না স্টিয়ারিং ধরাবার জন্য কিংবা সস্তার দিকে ঝুঁকছেন
একটি সত্যি কথা বলতে হয়, মাঝে মাঝেই দেখি অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ছেলেরা ট্যাক্টফুলি গাড়ি চালাচ্ছে কিন্তু অভিজ্ঞতা ও বয়সের বিচারে যাদের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি চালকের আসনে বসাবার জন্য তাঁদের অবস্থা দেখলে মনে হবেনা তাঁদের ঝোলা অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। যারা সচারচর বাসে চলাফেরা করেন তাঁরা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন যে, কিভাবে একটা বাসকে ধাক্কা মেরে কিংবা গা ঘেষে চলে যায়। পথিমধ্যে অযথাই এমন ভাবে স্পীড ব্রেক করে থাকে যাতে আসনে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশু, বয়স্ক মানুষ ও নারীদের জন্য এমন অভিজ্ঞতা আরো বেশি ঝুকিপূর্ন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যতবার বাসে উঠেছি ততবারই দেখেছি যাত্রীরা কখনও না কখনও চালককে ড্রাইভারকে তিরস্কার করতে, কিছু মানুষ আছেন যারা অকথ্য ভাষা পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকেন। যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের তোপের মুখে চালক পরিবর্তনের মতও ঘটনা ঘতে কিন্তু ওই চালক সম্প্রদায়ের উন্নতি আর চোখে পড়েনা সে অর্থে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে নির্দেশনা রয়েছে। ১. গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; ২. লং ড্রাইভের সময় বিকল্প চালক রাখা, যাতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কোনো চালককে একটানা দূরপাল্লায় গাড়ি চালাতে না হয়; ৩. নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি; ৪. অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা; ৫. সড়কে যাতে সবাই সিগন্যাল মেনে চলে- তা নিশ্চিত করা এবং পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করা; চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ নির্দেশনা আমার কাছে অনেকাংশে স্বপ্নের মত লাগে। আর বাস্তবায়ন এবং বাধ্যবাধকতা কিংবা বাধ্যবাধকতার জন্য কতটুকু কড়াকড়ি রয়েছে সেটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের বামেই রয়ে গেছে আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে।
খবরে দেখেছি কুর্মিটোলার সেই ঘাতক দুই বাসের রুট পার্মিট বাতিল করেছে, ড্রাইভারকে রিমান্ডে নিয়েছে এবং বাস মালিককে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু রুট পার্মিট কিংবা, গ্রেফতার করাই সমস্যার সমাধান নয়। ফিটনেস বিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্স বিহীন ড্রাইভার মুক্ত রাখতে হবে আমাদের সড়ক ও যানবাহন। পাশাপাশি ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে সবাইকে।
শেষের দিকে বলে যেতে হয়, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মানুষ যে শুধু গাড়ি চালকদের দোষারোপ করে থাকে তা অনেক সময় ঠিক নয়। পথচারীদের জন্য কিংবা কখনও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শহরের বিভিন্ন যায়গায় ও একাধিক রাস্তার সংযোগ স্থলে ফুট ওভার ব্রিজ থাকার পরেও মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়। পথচারীরা রাস্তা পার হওয়ার সময় একেকজন ট্রাফিক সার্জন বনে যান! যা সচেতন সমাজের পক্ষে সম্মানহানীকর এবং এমন প্রত্যেকটি চিত্র একেকটি অসচেতন সমাজ ও জাতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
- মু. মিজানুর রহমান মিজান
ইমেইল: mail@mizanurrmizan.info
#mizanurrmizan
Follow @MizanurRMIZAN
#mizanurrmizan