সৌদি আরবে হঠাত কেন এত পরিবর্তন? বিশ্বের
মানুষ তা নিয়ে নানান ভাবে ভাবছেন, আর দেশটির নাগরিকরাতো
সেদিকে নজর রাখছেনই। আধুনিকায়ন, নারীঅধিকার, ইরানের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলাসহ ইত্যাদিই প্রমান করে দিচ্ছে যে, সৌদি আরব পরিবর্তনের পথে হাঠছে। এছাড়া অন্যান্য ইস্যুতো থাকছেই। যুবরাজ
বিন সালমানের নেতৃত্বে সে দেশে চলছে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, যাতে অনেকের ধারণা তিনি নিজের ক্ষমতাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতে চান এবং সেটা
দেশের বাইরেও। দেশের একটি বিলাস বহুল হোটেল রাতারাতি পরিণত
হলো কারাগারে;
ধনকুবের রাজকুমাররা
হয়ে গেলো কারাবন্দী, এসব কিসের আলামত? এতে স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীন উত্তেজনা বেড়েছে, সাধারণ
জনগণও অনেক কিছুতে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
একটু পেছনে গেলে যাওয়া যাক, আজিজ আল সউদ ১৯০২ সাল
থেকে প্রতিষ্ঠা করত করেন তৃতীয় সৌদি রাজত্ব। যা ১৯৫৩ সালে তার মৃত্যুর পূর্বে পারস্য
উপসাগর থেকে লোহিত সাগর এবং ইরাক থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন, ইয়েমেনের সাথে
যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিল দেশটি। এই বাদশাহর ছিলো প্রায় ১০০ সন্তান যাদের মধ্যে ৪৫
জন পুত্রসন্তান বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজত্ব
ক্ষমতা একের হাত থেকে অন্যের হাতে ঘুরতে থাকবে, সে
হিসেবে একেকজন একেক গোষ্ঠীর নেতা হয়ে উঠেছিল। সঠিকভাবে ক্ষমতা বন্টন করে ভারসাম্য
রক্ষারও ব্যবস্থা করেছিল। এভাবেই চলছিল কয়েক দশক, কিঞ্চিত পরিবর্তনও ঘটছিলো। সব কিছুই ছিল স্থিতিশীল এবং কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা আগে থেকেই মোটামুটি অনুমান করা
যেতো। বর্তমান বাদশাহ ৮১ বছরের সালমান বিন আবদুল আজিজের ভাইদের বেশিরভাগই জীবিত নেই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে রাজত্ব
এখন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের সময় চলে এসেছে। এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে সিংহাসন আল-সউদ রাজ
পরিবারের ভিন্ন শাখার দিকে প্রবাহিত হতে চলেছে। অসুস্থ ও
বয়োবৃদ্ধ বাদশাহ সালমান তখন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুত্রসন্তান সালমানকে তড়িঘড়ি করে
ডেপুটি যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন তখন
ক্রাউন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ। তবে দু’বছরের মধ্যেই মোহাম্মদ বিন নায়েফকে বরখাস্ত করেন বাদশাহ সালমান। এরপর সিংহাসনের
উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেন তারই ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান। যেকারণে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দীর্ঘ্যদিনের প্রথা
ভেঙ্গে যায়। এতেই বদলে যেতে শুরু করে সবকিছু। নতুন যুবরাজ
মোহাম্মদ বিন সালমান রাতারাতি তার প্রতিদ্বন্ধীদের আটক করে জেলে প্রেরণ করতে থাকেন, এতদের মধ্যে অত্যন্ত বিত্তশালীরাসহ ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান। এতে করে কি একই পরিবারের কাছে সর্বক্ষমতা চলে আসলো না,
যা আগে কখনও ছিলোনা। যুবরাজও বোধহয় নিজেদের প্রভাব দেশের অভ্যন্তরের
পাশাপাশি বাইরেও বিস্তার করতে চাইছেন। যুবরাজের এই
উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিজেদের অর্থনৈতক গতিকে একটু শ্লথ কিংবা বিনিয়োগকারীদের ভীত করবে
নাতো?
ইতোমধ্যেই সৌদি আরব
বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ইরানের সাথে। আর দেশটিতো ইতোমধ্যেই সরাসরি যুদ্ধ করছে
ইয়েমেনে। বিবিসি বলছে, এই অবস্থা
থেকে সৌদি আরব এখন কোন দিকে যেতে পারে এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের এতোসব
পরিকল্পনার পরিণতি কি হয় সেসব দেখার জন্যে হয়তো আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে
হবে। আর ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের যে
সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে সেটা হয়ত মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব খাটানো প্রতিহত করতেই। ইসরায়েলি
সামরিক বাহিনীর সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও শীর্ষস্থানীয় সৌদি রাজকুমারদের
সাথে সাম্প্রতিক দুটো বৈঠকের কথা উল্লেখ করেছেন।
২০০৩ সাল থেকে
ইরাকে সুন্নি মুসলিমদের পরিবর্তে শিয়াদের আধিপত্য বাড়তে থাকে যে কারণে ইরানের সাথে
একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার ও রাশিয়ার সামরিক
সহযোগিতা ইরানের সাথে থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই একটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে ইরান। এর ফলে তেহরান থেকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত একটি ইরানি
করিডোর খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অনেক সুন্নি নেতাই এটিকে দেখছেন আরব মধ্যপ্রাচ্যে
বিদেশি পারস্য দেশের অনুপ্রবেশ হিসেবে। তাইতো শত্রুতা
কৌশলগত মাত্রা ছাড়িয়ে ধর্মীয় পর্যায়ে চলে গেছে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়াও যা দেখা যাচ্ছে তা হল‑ ইরান এবং লেবাননের হেযবোল্লাহ গ্রুপের মতো
তার মিত্ররাই যুদ্ধে জয়লাভ করছে বলে মনে হচ্ছে। হয়ত এ কারণেই নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে সোদি
আরব-ইসরায়েলের মধ্যে একটা কৌশলগত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েলও একই প্রয়োজন
অনুভব করে থাকতে পারে। আবার ইরান পরমানুতে শক্তিধর হোক সেটা ভাল লাগছেনা সৌদি
আরবের, এই ইস্যুতে। ট্রাম্প অন্যতম একটা প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছে। সৌদি আরব যাই করছে ট্রাম্প
সমর্থন করছেন ও সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু ট্রাম্প যে জেরুজালেমকে
ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন এতে অখুশি বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ এবং একে
জঙ্গিদের জন্য অক্সিজেন হিসেবে মনে করছেন তাঁরা। অবশ্য পুরো বিশ্বই এর প্রতিবাদ
করছে। ওয়াশিংটন প্রশাসনের বিপক্ষে কোন অভিযোগ নেই রিয়াদের, ট্রাম্পও সৌদি আরব ঘুরে
গেছেন। সে সময় ইরানের পরমানু কর্মসূচি ও তেহরানের সাথে চুক্তির কড়া সমালোচনা
করেছেন। ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রিরও আগ্রহ প্রকাশ
করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এভাবেও বলেছেন যে, সৌদি আরব জানে যে
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাঁদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভাল সম্পর্ক বয়ে আনবেনা। আর
মধ্যপ্রাচ্যের যে বিশেষ নীতি রয়েছে তা থেকেও সরে আসছে যা অন্যদের চোখ রাঙাতে বাধ্য
করবে। একই সাথে এটাও স্পষ্ট মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষীয়মাণ মার্কিন নীতি ও
রাশিয়ার ফিরে আসার সাথে নতুন করে সামঞ্জস্য তৈরিতে কাজ করছে সৌদি আরব ও ইরান- এই
দুটো দেশই।
সৌদি যুবরাজ
একদিকে যেমন ইরানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তেমনি অন্যদিকে
তিনি তার দেশকে আরো আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছেন যার জন্য তিনি নয়া নয়া সব কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। এসবের মূলে ‘আরব বসন্ত’র ভয়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যা সৌদি আরবের যুবরাজের কথা ও
কাজ থেকে প্রমানিত হয়, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন চাচ্ছেন কিন্তু সেটা কি রকম তা
তাঁর কথায় ফুটে উঠেনা। তবে এ পরিবর্তন নিজের দেশ থেকেই শুরু এবং ইরানের বিরুদ্ধে
জোর আন্দোলনের কথা বলেছেন। আর ‘আরব বসন্ত’ হল‑ ২০১০ সালের শুরু
থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড়, এ নামটি সাংবাদিকরাই
দিয়েছেন। যুবরাজের এই ‘প্রায় একঘেয়েমিতা’ কি সে দেশের জনগণ ঝুঁকি বলে মনে করছেন
না?
শেষ কথা হল
আরবের এই নয়া কৌশল কতটুকু বাস্তবায়িত হবে বা ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব বা কতদিন
টিকবে? আরো একটি কথা এখানে থেকে যায়, আর তা হলো‑ ‘আরব বসন্ত’ এড়াতে হলে বা শুভ
কিছুর আশা করতে গেলে ফিলিস্তিনের জন্যও শুভ কিছু করতে হবে আগে, আর দেশের ভেতরেও
সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজের নেতৃত্বকে গ্রহনযোগ্যপন্থায় শক্তিশালী করতে হবে; আপাতত
এটাই মনে হচ্ছে।
- মু. মিজানুর রহমান মিজান
(দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭)